26 C
আবহাওয়া
১:০৮ পূর্বাহ্ণ - এপ্রিল ১৭, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » ‘রোগী’কে নয়-করোনাকে ঘৃণা করুন

‘রোগী’কে নয়-করোনাকে ঘৃণা করুন


।।মিজানুর রহমান মজুমদার।।‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির মেয়র মহোদয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি আকুল আবেদন। সাধারণ জনগণের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিদের লাশ খিলগাঁও তালতলা কবরস্থানের পরিবর্তে ঢাকার বাহিরে বা অন্য কোন নিরাপদ স্থানে দাফন করার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি’। ঢাকার তালতলা কবরস্থানের ফটকে এমন ব্যানারটি খিলগাঁও ও রামপুরা থাকা এলাকার সর্বস্তরের জনগণের নামে সাঁটানো হয়েছে।

ব্যানারটি পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, শিক্ষিত ব্যক্তিরাই এ ব্যানারটি লাগিয়েছেন। শিক্ষিত ব্যক্তি মানে সচেতন নয়, চিন্তা চেতনা ও মানসিকভাবে উন্নত নয়। চীনের জাতির পিতা মাও সেতুং আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘দিনদিন শিক্ষিত মূর্খের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে’। উল্লেখিত ব্যানারটিই তার প্রমাণ। এলিট শহর খ্যাত ঢাকায় বসবাসকারি মানুষের এমন মানসিকতা! এরা সনদধারি শিক্ষিত হলেও চিন্তা চেতনায় এখনো মূর্খ।

করোনাভাইরাস বাতাসে ছড়ায় না। এটি মানুষ থেকে মানুষে সংর্স্পশে, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। এক মিটার দুরত্বে থাকলেই নিরাপদ। এছাড়া মৃত ব্যক্তির শরীরে তিন ঘন্টার বেশি ভাইরাসটিও মারা যায়। মাটি চাপা দিলে শতভাগ নিশ্চিত যে মরদেহ থেকে করোনা ছড়ানোর কোন সম্ভাবনায় নেই। এ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সব গণমাধ্যম এ ব্যাপারে প্রচারণা চালাচ্ছে। তবুও কেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিকে কবরস্থ করতে বা সামাজিক দুরাত্ব বজায় রেখে জানাযা পড়তে বাধা দেওয়া হচ্ছে? ঘন্টার পর ঘন্টা মরদেহ পড়ে থাকছে। কেউ কাছে যাচ্ছে না, কাছে যেতে দেয়া হচ্ছে না! ফলে বিড়ম্বনায় পড়ছেন মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আইইডিসিআর এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাটিতে লাশ দাফনে কোনো ঝুঁকি নেই। করোনায় মৃতের দেহ থেকে সংক্রমণ ছড়ায় না। এজন্য তারা কিছু নিয়মকানুনও ও পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা!

সম্প্রতিককালে করোনা রোগী ও অন্যকোন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেও তাকে কবরস্থ করতে বাধা দেয়ার কালচারটি সারাদেশে করোনা ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। করোনায় আক্রান্ত বা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হলেই বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটছে। জনমনে অহেতুক আতঙ্কের কারণে কোডিভ১৯ ছাড়াও অন্যান্য রোগে মৃত্যুবরণকারীদের কবর দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বজনদের পরতে হচ্ছে নানা জটিলতা  বিড়ম্বনায়। মৃতের প্রতি এই নির্দয় আচরণ কারো কাম্য না হলেও এই পরিস্থিতির পেছনে গুজবঅজ্ঞতা, সামজিক অবক্ষয় এবং ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব অনেকাংশ দায়ী। সারাদেশেই অসুস্থতা নিয়ে কেউ মারা গেলেই তাকে নিয়ে চলছে গুজব এবং দাফন নিয়ে জটিলতা। জানাজায়ও অংশ নিচ্ছে  হাতেগোনা মানুষ।

গণমাধ্যমের খবর অনুয়ায়ি অন্তত: অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুর লাশ কবরস্থ করতে বাধা দেয়া হয়েছে। বগুড়ার শিবগঞ্জ এবং জামালপুরের বকশীগঞ্জে সর্দি-কাশি-জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃতের লাশ দাফন নিয়ে স্থানীয় একশ্রেণির লোক বাধার সৃষ্টি করেছে। অনেক বিপত্তিতে ১৪ ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পর সরকারি জমিতে বগুড়ার সহকারী পুলিশ সুপার কুদরত ই খুদা শুভ কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিয়ে লাশ দাফন করেন। মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন বা এলাকাবাসীকে দাফনে অংশ নিতে দেখা যায়নি।

গত ১৪ মে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলায় হাঁপানী ও শ্বাসকষ্টে মারা যাওয়া করোনা উপসর্গের সন্দেহের মৃত্যু ব্যক্তির দাফন কাজে এলাকাবাসীর বাঁধা দেয়। বীরগঞ্জ উপজেলার ৪নং পাল্টাপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ রঘুনাথপুর গ্রামের জয়নাল মিস্ত্রীর ছেলে আব্দুল মোমিন (২৬) ১৪ মে বৃহস্পতিবার দীর্ঘদিন হাফানী ও শ্বাসকষ্টজনিত কারণে নিজ বাড়িতে মারা যান। পরবর্তীতে, খবর পেয়ে বীরগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জনাব মোঃ রমিজ আলম ঘটনাস্থলে যান এবং তাঁর উপস্থিতিতে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক বৃহস্পতিবার বিকাল ৫ টার দিকে লাশের তায়াম্মুম করে জানাজা নামাজ পড়ান এবং পার্শ্ববর্তী কবরস্থানে দাফন করেন।

ফেনীর শর্শাদির আবুপুরের লোকজনতো আরো একধাপ এগিয়ে! গত ১৪ এপ্রিল ঢাকায় কিডনি সমস্যায় মারা যান ৬০ বছর বয়সী হাজেরা খাতুন। তার লাশ ফেনীর শর্শাদিতে আনা হয়। গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তিনি। শতশত গ্রামবাসি লাঠি নিয়ে আক্রমণ করে হাজেরা খাতুনের বাড়ি। ভাংচুর করে অ্যাম্বুলেন্স! মরদেহ নামাতে বাধা দেয়া হয়। ‘ফতোয়া’ দেয়া হয় এ মরদেহ কবরস্থানে দাফন করা যাবে না। কেউ জানাযা পড়াবে না। ৪ ঘন্টারও বেশি সময় মরদেহ পড়ে থাকে। তাদের বক্তব্য, করস্থানের পাশ দিয়ে গ্রামবাসি চলাচল করে, কবর থেকে উঠে আসা করোনা ভাইরাসে তারা আক্রান্ত হবেন!

খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান ফেনী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসরিন সুলতানা ও পুলিশ দল। শেষ পর্যন্ত  উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তত্ত্বাবধানে মরদেহটি কবরস্থ করা হয়। জানাযায় অংশ নেয় পুলিশ ও মরা যাওয়া নারীর স্বজনরা। এভাবে স্থানীয় লোকজনের রোষানল থেকে রক্ষা পায় এক মায়ের মরদেহ!

এর একমাস পর গত ১২ মে ছাগলনাইয়া থানার পশ্চিম ছাগলনাইয়ায় আরেক ঘটনা ঘটে। ন্যাশনাল ক্রেটিড ব্যাংক লিমিটেড এর প্রিন্সিপাল শহীদুল্লাহ মজুমদারের স্বাভাবিকভাবে মৃত্য হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে তার লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গেলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ফলে এলাকার কোন লোক তাকে করব দিতে আসেনি। খবর পেয়ে এগিয়ে আসেন, ছাগলনাইয়া পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ মোস্তফা।তার তত্ত্বাবধানে পরিবারের সদস্য ও কয়েকজন পড়শি মিলে এনসিসি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার শহীদুল্লাহ’র জানাযা শেষে কবর দেয়া হয়।

যারা এমন কান্ড করছে, আতঙ্ক, গুজব ছড়াচ্ছে তাদের চলাফেরা কিন্তু সচেতনমূলক নয়। এরা করোনা ভাইরাসকে পাত্তা দেয় না। মানছেন না সরকারের কোন নির্দেশনা। মাস্ক ছাড়া যাচ্ছে হাটে, ঘাটে, শপিং মল ও মসজিদে। মানছে না শারিরীক দুরাত্ব। গাদাগাদি করে চড়ছে ট্রাক, প্রাইভেট, সিএনজি অটো ও মোটরবাইকে। অথচ তারাই মৃত ব্যক্তির দেহের করোনা কবর থেকে উঠে তাদের শরীরে ছড়াবে এমন শঙ্কায় থাকছে।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের মুম্বাইয়ে মালাডে পিলে চমকে দেয়ার মতো ঘটনার জন্ম দিয়েছে সেখানকার কথিত মুসলমানরা। গত ২ মার্চ শ্বাসকষ্ট নিয়ে যোগীশ্বরী হাসপাতালে মারা যান এক মুসলিম বৃদ্ধ। তাকে কবরস্থ করতে গ্রামে নেয়া হলে স্থানীয় মুসলিম কমিউনিটি তাকে কবরস্থ করতে অস্বীকার করে। স্বজনরা মরদেহ বাড়িতে রেখে গণ্যমান্য ব্যক্তি, পুরসভা (পৌরসভা)’র কর্তাদের কাছে গিয়ে কোন সমাধান পায়নি। ওই মুসলিম বৃদ্ধার মরদেহের সমাধি হয়নি। তার স্থান হয়েছে  শ্মশানে! স্বজনরা   মরদেহ থেকে ছড়িয়ে পড়া উৎকট দুর্গন্ধ থেকে রক্ষা পেতে স্থানীয়  হিন্দু সৎকার সমিতির দারস্থ হয়। তারা শ্নাশানে দাহ করার অনুমতি দেয়। অবশেষে স্বজনরা ইসলামের অনুসারি মুসলমানকে শ্মশানে দাহ করতে বাধ্য হয়েছে! এ যেন অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কালজয়ী সৃষ্টি ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের কাল্পনিক চরিত্রের বাস্তবরূপ।

প্রায় একশত বছর আগে  শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে এক সংলাপে লিখে ছিলেন, মরার আবার জাত কি? এই সংলাপ তো অনেকের কাছে প্রবাদ তুল্য। ভারতের হিন্দুরা একজন মুসলমানকে দাহ করে প্রমাণ করেছে মরার কোন জাত নেই। তারও সৎকারের অধিকার আছে।

প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও মরদেহ কবরস্থ করতে বাধা ও গুজব রটিয়ে মৃত ব্যক্তি ও তাদের পরিবার-পরিজনকে মানসিক হয়রানি ও বিরূপ পরিস্থিতিতে ফেলে দিচ্ছে। এর নেপথ্য রয়েছে কতিপয় মূর্খ, চিন্তা-চেতনায় পিছিয়ে পড়া অতিউৎসাহী মুসলমান খ্যাত অমানুষ। অবাক বিস্ময়কর হচ্ছে, মুসলমানরাই মুসলমানদের কবরস্থ করতে বাধা দিচ্ছে। মানবিকতা সামাজিক ও ধর্মীয় দায়বদ্ধতা নেই। অথচ মুসলমান অর্থাৎ ইসলাম ধর্মামলম্বীদের জন্য এটি  ফরজে কেফায়া বা সমাজের জন্য আবশ্যকীয় দায়িত্ব অর্থাৎ কোনো মুসলমানের মৃত্যু হলে মুসলমান সমাজের পক্ষ থেকে অবশ্যই জানাযার নামাজ পাঠ করতে হবে। কিন্তু এখন? সমাজ-সভ্যতার কী জাহেলিয়াতের যুগে ফিরে যাচ্ছে? সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, এটি সামাজিক, ধর্মীয় অজ্ঞতা ও মূল্যবোধ হীনতার চূড়ান্ত রূপ। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রর্দশন|

এখানে শেষ নয়, হাসপাতালে পিতার লাশ রেখে হুইল চেয়ার নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে চট্টগ্রামে। সংক্রমনের ভয়ে জানাযায় অংশ নিচ্ছে না নিজের সন্তানরা! অথচ মাস্ক পরিধান করে এক মিটার (৩ফুট) দুরাত্বে জানাযায় অংশ নিলে করোনা ভাইরাসে সংক্রমণের কোন ভয় নেই।  অথচ মরদেহ কবরে করলেই যেন ভাইরাস তাদের আক্রমণ করবে, এর আগে নয়! যেন সব দোষ ওই মরদেহের। ভাবছেন না, আগামিকাল হয়ত তারই বা তার পরিবারের কারো মরদেহ পড়ে থাকবে। কেউ এগিয়ে আসবে না । উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াবে। কাক শুকুন ও শিয়াল ভক্ষণ করবে! এটি সভ্য সমাজে কাম্য হতে পারে না।

তথাকথিত এসব মানুষের রোষানল থেকে বাদ যাচ্ছে না করোনা রোগীদের সেবা প্রদানকারি সম্মূখ যোদ্ধারাও। তারাও নানা সামাজিক বিড়ম্বনা পড়ছেন অহরহ। কোয়ারেন্টিনে থাকা করোনা আক্রান্তদের ঘরে ঘরে তালা দিয়ে বন্দি করে রাখার ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম মহানগরীর বাকলিয়ায়। সাতকানিয়ায় বাড়ি ভাংচুর করার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেকে লুকিয়ে রাখছেন। পরীক্ষা করাচ্ছেন না। ফলে করোনা ভাইরাসের সামাজিক সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এখনই তথাকথিত মুখোশধারি এসব মানুষের লাগাম টেনে ধরা এবং এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণ জরুরি। নতুবা পুরো জাতিকে এর খেসারত দিতে হবে। আসুন, সবাই করোনা রোগীকে নয়-করোনাকে ঘৃণা করি। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি বা তাদের পরিবারকে সহায়তা করি, তাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার চোখে দেখি। এতেই গড়ে ওঠবে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৈষম্যহীন ‘সোনার বাংলা’।

Loading


শিরোনাম বিএনএ